(দ্বিতীয় পর্ব)
ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যচর্চায় নিজস্ব নৃত্যধারা গড়ে তুলেছেন। ভরতনাট্যম, ওড়িশি, রাশিয়ান ব্যালে বিভিন্ন ঘরানার নৃত্য তাঁর নৃত্যশৈলীতে এসে মিশেছে স্বতন্ত্র রসায়নে। নৃত্যনির্মিতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা তাঁর অভ্যেস। তবে সেটাই তাঁর একমাত্র কাজ নয়। তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে লুপ্ত থাকা নাচের ছন্দটি দেখতে পেয়েছেন অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে। তালভঙ্গের জীবনকে সুরে-তালে-লয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন। আজ মানুষ তাঁকে চেনে পশ্চিমবঙ্গ সংশোধনাগারের বন্দিদের জীবনকে ছন্দে ফিরিয়ে দেওয়া একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে।
শিল্পী অলকানন্দা রায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন ‘শনিবারের চিঠি’র প্রতিনিধি পাপিয়া চৌধুরী।
পূর্ববর্তী পর্ব ছিল একজন মেয়ে, যার পায়ে নাচের ছন্দ, তার পরিণত শিল্পী হয়ে ওঠার কথা। এবার শোনা যাবে সেই শিল্পীর নৃত্যের ছন্দকে খুঁজে বের করার এক দীর্ঘ পরিক্রমা। খুঁজে বের করা, সেইসব মানুষের মধ্যে থেকে, যাদের জীবনের ছন্দ হারিয়ে গিয়েছে অন্ধকারের গোলকধাঁধায়। সেটাই তাঁর, দেশ এমনকী বিদেশের কারাবন্দি মানুষদের ছ্ন্নছাড়া জীবন ছন্দ-বন্ধনে ধরার জার্নি। যা ‘রত্নাকর’দের ‘বাল্মীকি’তে রূপান্তরিত করার, অন্ধকারের মানুষগুলোকে আলোর পথ দেখানোর জার্নি। যেখানে অলকানন্দা রায় নিজেই এক মাইলস্টোন।
জননী বলে শুধু ডাকিব
‘বাল্মীকি প্রতিভা’র নির্মাণের সময়টা বোধহয় ২০০৭। ‘মুন্নিদি’ বলে চলেছেন তাঁর পূর্বস্মৃতি, আত্মচারণায় …আই ওয়াজ চ্যানেলাইজড দেয়ার আনইউটিলাইজড এনার্জি। কলকাতার সংশোধনাগারে যখন যাই, তখন আমার মিড ফিফটি মাদার ফিগার, ইমোশনাল কানেকশন ইত্যাদি নিয়েই তাদের সঙ্গে গড়ে উঠেছে এই সম্পর্কটা। স্নেহ, ভালবাসা ও জেনুইননেসটা ম্যাটার করে। ওরা ভীষণই সেনসেটিভ এবং শার্প। প্রথম প্রথম তো ওরা ভাবত, ওদের মধ্যে কেন গিয়েছি! তারপর ধীরে ধীরে যখন বুঝল, আমি ওদের কথা ভাবি বা ওদের ভালোর জন্য কিছু করতে চাই, তখন আস্তে আস্তে বিশ্বাস করতে শুরু করে। একবার বিশ্বাস করতে শুরু করলে অনেক কিছুই সহজ হয়। আগে ‘ম্যাডাম’ বলেই ডাকতো, হঠাৎ একজন একদিন ‘মা’ ডাকে। এই ‘মা’ ডাক এমনই যে, শ্রবণ ও হৃদয় স্পর্শ করে। কবে যে এটার শুরু, বলতে পারি না। সংশোধনাগারে সকলের ‘মা’ হয়ে ওঠা খুব মসৃণ ছিল না। তখন এমনও হয়েছে কোথাও গিয়ে ভালো কিছু খেলেও ওদের কথাই মনে পড়ত। ওদের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করলে ওরাও নর্ম্যালি রেসিপ্রোকেট করে, বিটারনেস কম হয়। সিস্টেমের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
প্রথম দিকে যে খাবারগুলো ওদের দিত, এখন তা অনেক ইমপ্রুভ করেছে। কোনও কোনও সুপারিনটেনডেন্ট লিবার্টি দেন, তাতে ইনমেটরাও খুশি হয়। যখন কোনও বিটারনেস তৈরি হয়, তখন সবেতেই মাথা গরম ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এখন তো অনেকটা বদলেছে– দে আর হ্যাপি। প্রত্যেকেই স্নেহ, ভালবাসার কাঙাল। আমাদের শেখা উচিত কী করে স্নেহ ভালবাসা দিতে হয়। ইফ সামবডি ফিল গুড, দে উইল ডু গুড। প্রত্যেকেরই সেল্ফ রেসপেক্ট আছে। আমেরিকায় লোকে ভাবতেই পারে না যে প্রিজনাররা বাইরে যাবে। ওখানে শেক্সপিয়রের নাটক হয়, কিন্তু ভেতরেই। ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে প্রোগ্রাম করা ওখানে কল্পনাতীত। আমাদের এখানে যেভাবে প্রিজনারদের নিয়ে বাইরে গিয়ে অনুষ্ঠান করে– ট্রেনে, বাসে অন্য রাজ্যে যাচ্ছে, সেটা পৃথিবীর কোথাও হয় না। সেইজন্য ওদের খুবই কৌতূহল, কী করে সম্ভব! বিদেশে বলে ‘কারেকশন্যাল ফেসিলিটি’। এখানে সেটা ‘কারেকশন্যাল হোম’। বিদেশে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়, এখানে ইনমেটরা বাড়ির অনুভূতিটা পায়। এই তফাৎটাই বিশেষত্ব। ওখানে তো ডক্যুমেন্টারিটা দেখে সবাই আমাকে ‘মামমা রায়’ বলে ডাকা শুরু করল।
আমি অন্ধকারের যাত্রী, আলোর দৃষ্টি দাও
বিদেশে জেলের ভেতরে যখন গেলাম, বন্দিদের প্রথম প্রশ্ন ছিল— ‘তুমি কি ছুরি তৈরি করতে পার!’ একটি ছেলে প্রায় তেইশ বছর সেখানে বন্দি, খুবই সুন্দর তাঁর দুটি চোখ, কালো, সে শেক্সপিয়রের নাটকে লিড রোল করে, অথচ সবই জেলের গণ্ডির ভেতরে। ওখানে গ্যাঙওয়ারটা খুব চলে, এখানেও আগে ব্লেড নিয়ে মারামারি এসব চলত, প্রথম দিকে, এখন এই সমস্ত খুবই কমে গেছে।

সানফ্রানসিসকোর সেই সুন্দর কালো কান্তির ছেলেটি ডোমিয়ন, খুবই শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে, ‘মামমা’ বলে। আসতে চায় এখানে। আর আমি বলি—‘এখানে এলেই তোমায় জেসাস ক্রাইস্ট করাবো।’ আমরা যে ঘরোয়া পরিবেশটা এখানে দিতে পারছি, ওদেশে সেটা নেই, আছে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা, পার্থক্য ও বিশেষত্ব এটাই।
এখানকার ছেলেমেয়েদের অনেক শাসন করি, অনুষ্ঠানের সময় তো একই রকম পোশাক পরা থাকে। কত যে কিল-ঘুষি খায, ওরা কিচ্ছু মনে করে না। পরদিন যখন জিজ্ঞাসা করা হয় কে কে মার খেয়েছে, হাত তুলে দেয়, আদর করে দিই। ওদের তো কেউ আদর করে না, ওরা আমার কিলটাও খেতে রাজি, এই আদরটা পাওয়ার জন্য। এমনিতেও আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, মার খেলে আর একটু এক্সট্রা আদর আর কী!
তবে এই পরিস্থিতিতে আসার পথ মোটেই সহজ ছিল না। প্রবলেম হয়েছে, ওভারকামও হয়েছে। বি ডি শর্মা সবসময় সহায়তা করেছেন, খুবই প্যাশনেট ছিলেন। দশজন এডিজি-র সঙ্গে কাজ করেছি, প্রত্যেকেই সাহায্য করেছেন। ২০১৪-তে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সময় মরাল কোড অফ কন্ডাক্ট (এমসিসি) চলছিল ইলেকশনের আগে, কেউ তখন সাহসই পেত না পাঠাতে। তখন মি. অধীর শর্মা ছিলেন, উনি তো পাঠিয়ে দিলেন, প্রত্যেকটা স্টেট যখন ক্রশ করছি পুলিশদের বলা ছিল। শুধু বলেছিলেন, এবার যেন ওরা বাইরে ঘুরতে ও শপিং করতে না যায়। ইলেকশনের আগে- তাই ওদের জন্য কড়াকড়ি। তবে ওদের জন্য সিনেমা দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল, কোল্ড ড্রিংকস, চিপস সহ। ওদের বোঝাতে হয়। ওরা ইচ্ছে করলে জল ভরতে নেমে পালিয়ে যেতেই পারত, টয়লেট যাওয়ার নাম করেও পালাতে পারত, কিন্তু কখনও এমনটি করেনি।

প্রত্যেক অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে কাউন্সেলিং করা হয়, কোনটা করবে, কোনটা করবে না বা কী করবে। অফিসারদের অনুমতি নিয়ে বা বলে যা করার করবে। অনুমতি না পেলে, কখনও মাথা গরম না করতে সকলের মধ্যে। বুঝিয়ে বলি। তাতে সুফলও মেলে। ওদেরকে বলা হয়, এমন কিছু যদি মনেও হয়, যেন কিছু না করে– যাতে পুরো টিমের বদনাম হয়। তাতে বলে ‘মা’, আপনি আমাদের এত সম্মান দিয়েছেন, আপনার মাথা নত হয় তেমন কখনও কিছু করতে পারবো না। লোকে আমাদের এখন অন্য চোখে দেখে। মানবিক স্পর্শ পেয়ে তারা অনেক বদলিয়েছে। আমার ছেলেরাই সবকিছু দেখে রাখে বা পাহারা দেয় সবাইকে, যাতায়াতের সময়। তারা অনুভব করে যে, অনেকেই তাদের শিল্পীর চোখে দেখছে।
কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা
পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠানের পর মেলায় যেতে চাইলে, বললাম বলব, কিন্তু যদি না করে, তবে বুঝবে, সত্যিই কিছু অসুবিধে আছে। কিন্তু আমি বলাতে, ওদের মেলাতে যেতে দেওয়া হয়। এগুলি কম বড় কথা নয়। তবে কোনও জিনিস শুরু করে বয়ে নিয়ে যাওয়া একই রকমভাবে বেশ শক্ত কাজ, সেটা অনেকেই বুঝতে পারে না। এত বছর ধরে যে কাজটা চলছে, তাতে পুরনো ইনমেটসদের ভূমিকাও থাকে, পুরনোরা নতুনদের বোঝায়, আবার কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং করে নাচও করায়, বলে মা আমরা দেখিয়ে দেবো, আপনি এসে ওদের ঠিক করিয়ে দেবেন।
সিনিয়রিটি ব্যাপারটা কাজ করে। নতুন কিছু আরম্ভ করলে, তার যে ইনিশিয়াল এনথুজিয়াজিম কাজ করে, পরে সেটা তো সেইভাবে থাকে না। অনেক নতুন আসছে, চলেও গেছে বাইরে নতুন জীবনে। নতুনদের তৈরি করে নেওয়া যথেষ্ট কঠিন। যেহেতু এরা কেউই প্রকৃতই ফাইন-আর্টস-এর নয়। অথচ ওদের নানান প্রতিভাও আছে, সেগুলোও কাজে লাগানো হয়। বিভিন্ন প্রোডাকশনের পোশাক, প্রপস সবই ওদের হাতে তৈরি। ওরা বিশ্বাস করে, আমার জন্য এক নতুন জীবন পেয়েছে। সম্মান পেয়েছে। ওদের নিয়ে যা ভাবি, ভালোর জন্য যা কিছু করি, সেটা ওরা বিশ্বাস করে, নির্ভরও করে। ইফ ইউ ট্রাস্ট দেম, ইফ ইউ গিভ দেম এ হিউম্যান টাচ, দে উইল ডু এনিথিং ফর ইউ। পিপল স্যুড নো অল। ভালোবাসায় অনেক কিছু করা যায়, করিয়ে নেওয়া যায়, অবশ্যই সেটা জেনুইন হতে হবে। যে বিশ্বাস অর্জন হয়েছে, বা পেয়েছি, ওরাও সেটাকে রেসপেক্ট করে, বলে কখনও আমার মাথা নীচু করবে না। এটা একটা বড় ‘কি পয়েন্ট’।
যখন প্রথম বাইরে প্রোগ্রাম করতে যাই, তখন অনেকে আন্ডার ট্রায়ালস-এ ছিল। তারা প্যারোলে(শর্তাধীন মুক্তি/অস্থায়ী মুক্তি) পায় না। য়খন শুরু হয়, বাইরে অনুষ্ঠান হবে এই ভেবে তো শুরু হয়নি। সেজন্য আন্ডার ট্রায়ালদের অনেক কান্নাকাটি। কোর্টের থেকে অর্ডার বার করা ইত্যাদি, এরপরেও বলা হল— সবাই যাবে কিন্তু একজনকে অ্যালাও করা যাবে না, তার জন্যেই অনুরোধ করা হয়। আমি রিস্ক নিয়ে বলি, ও কিছু করবে না, কিছু করলে আমায় হ্যাঙ করবেন। এতটা রিস্ক নিয়েছিলাম কারণ, ওদের উপর আস্থা ছিল যে ওরা কিছু করবে না। অনুষ্ঠানের পর স্ট্যান্ডিং ওভেসনস যখন পেল, সেটা ছিল ওদের বিজয় উচ্ছ্বাস। কী যেন জয় করে ফিরলো, নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে প্রপস (শিঙা, থালা, বাটি, ঢোল) বাজিয়ে।
ওদের সেই আনন্দ, তখন আমার আনন্দ হয়ে গিয়েছিল। মনে হত, আমি ওদেরই একজন। সেসব অনুভূতির কথা শোনাব আবার।